ভারত বাংলাদেশ পানি বন্টন চুক্তির বর্তমান অবস্থা

ভারতের সাথে গঙ্গা চুক্তির ২০ বছর: কী পেল বাংলাদেশ?

=======================================

নদীতে নৌকা বাধাছবির কপিরাইটবিবিসি
Image captionপদ্মা নদী ও এর শাখা নদীগুলোকে ঘিরে ছিল যাদের পেশা, দিন দিন কমছে সেই জেলেদের সংখ্যা ও তাদের নৌকা।

ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে গঙ্গা নদীর পানি ভাগাভাগির বিষয়ে যে চুক্তি হয়েছিল,তার কুড়ি বছর পূর্ণ হলো আজ সোমবার।
১৯৯৬ সালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং ভারতের তখনকার প্রধানমন্ত্রী এইচ ডি দেবেগৌড়া ত্রিশ বছর মেয়াদী এই চুক্তি সই করেন।
ভারত পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদে ফারাক্কা বাঁধ নির্মানের কারণে ভাটিরদেশ বাংলাদেশ প্রয়োজনীয় পানি না পাওয়ায় যে সংকট তৈরি হচ্ছিল, তা থেকে মুক্তির জন্যই এই চুক্তিটি হয়েছিল।
কথা ছিল দুই দেশ ন্যায্যভাবে পানি ভাগ করে নেবে।
কিন্তু প্রায়ই এই অভিযোগ করা হয় যে চুক্তি অনুযায়ী পানি পায়নি বাংলাদেশ। কুড়ি বছর পরে এসে এই চুক্তির বিষয়ে পদ্মা নদী এলাকার মানুষেরা কী বলছেন?
আর পানির ভাগ পাওয়ার যে কথা ছিল তা কতটা মিলছে?
হারিয়ে গেছে নদী-কেন্দ্রীক পেশা
রাজশাহীর কাজলাঘাট এলাকায় এক সময় অনেক জেলে পরিবার বাস করতো। নদীর মাছ ধরে বাজারে বিক্রী করাই ছিল যাদের পেশা।
কিন্তু এখন নদীতে মাছ ধরা ছেড়ে অনেকেই বেছে নিচ্ছেন অন্য নানা পেশা।
এমনই একজন মোঃ মহসিন মিয়া। বাবা-দাদার পেশা ছিল মাছ ধরা।
শুরুতে মাছই ধরতেন। তবে এখন চা-পান-বিড়ি-চিপস ইত্যাদি নিয়ে দোকানদারি করছেন।

বাংলাদেশ, ভারতছবির কপিরাইটGOVERNMENT WEBSITE
Image captionফারাক্কা বাঁধের কারণে বাংলাদেশে পানির প্রবাহ কমতে থাকার প্রেক্ষাপটে ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে গঙ্গা চুক্তি হয়।

কাজলা ঘাটে ঢোকার মুখেই তার দোকানে কথা হচ্ছিল মহসিন মিয়ার সাথে।
তিনি বলেন, "বাপ-দাদা মাছ ধরতো। আমিও ১৫ বছর মাছ ধইরছি। কিন্তু নদীটা শুকায়ে গেল। মাছ আর হয় না। বাধ্য হইয়া যে কোন কর্ম করতে লাগলাম। বাধ্য হইয়া দোকান দিলাম। ফারাক্কা বাঁধ দিয়ে দিল আর নদীটা শুকাতে লাগলো।"
রাজশাহী, পাবনা কিংবা ঈশ্বরদীতে পঞ্চাশোর্ধ জেলেদের অনেকের সাথেই কথা হয়।
তারা জানান গত ২০/২৫ ব্ছর ধরে নদীর পানি কমতে থাকায় তারা পিতৃপুরুষের পেশা মৎস শিকার ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন।।
'আগের নদীর গর্জন নেই'
নদী বিষয়ে কথা শুরু করতেই স্মতিচারণ শুরু করে দেন এক সময় নদীকে কেন্দ্র করে জীবিকা চালানো মানুষেরা।
আগে জেলে পেশায় ছিলেন এমন একজন বলেন, "আগে তিন মাইল দূর থেকে ডাক শোনা যেত নদীর। ছাকনা দিয়ে ইলিশ ধরা হতো। অনেক সময় উপরেও উঠে যেত"।
আরেকজন বলেন, "আগে নদীতে বিভিন্ন ধরনের মাছ পাওয়া যেত। সব ধরনের মাছই ছিল। রাজশাহী থেকে নবাবগঞ্জ, খোলাবুনা, বাবলাবুনা, ক্যাডেট কলেজ এইসব এলাকায় মাছ ধরতাম"।

নদীর পানি অনেক নেমে যাওয়ায় হার্ডিঞ্জ ব্রিজের নিচে চলছে ফুলকপির চাষবাস।ছবির কপিরাইটবিবিসি
Image captionনদীর পানি অনেক নেমে যাওয়ায় হার্ডিঞ্জ ব্রিজের নিচে চলছে ফুলকপির চাষবাস।

'বাংলাদেশের ক্ষতির পরিমাণ বেশি'
রাজশাহী শহরের গায়ের সাথে জড়িয়ে আছে পদ্মা। কিন্তু নদীর তীর ধরে চলতে থাকলে চোখে পড়ে বিশাল এলাকাজুড়ে চর ।
'টি বাঁধ' নামে পরিচিত একটি শহররক্ষা বাঁধ থেকে ট্রলারে করে চরে পৌঁছে দেখা যায় বহু লোক সেখানে বৈকালিক ভ্রমণে এসেছেন।
চরে দাড়িয়ে কথা হচ্ছিল নদী গবেষক এবং লেখক মাহবুব সিদ্দিকীর সাথে।
তিনি বলেন, "এই চুক্তির ফলে বাংলাদেশের উপকার যা হয়েছে, ক্ষতি হয়েছে বেশি। নদীকে ঘিরে পেশা ছিল এমন মানুষেরা গ্রামকে গ্রাম থেকে উচ্ছেদ হয়ে গেছেন, ইকোসিস্টেম নষ্ট হয়ে গেছে। অনেকে দেশ ছেড়ে গেছে"।

চরে দাড়িয়ে শায়লা রুখসানার সাথে কথা বলছেন গবেষক মাহবুব সিদ্দিকী।
Image captionপানির প্রবাহ না থাকায় নদীর বুকে জেগে ওঠা চর। সেখানে দাঁড়িয়ে নদী গবেষক মাহবুব সিদ্দিকী বলছিলেন, বাংলাদেশের উপকার যা হয়েছে, ক্ষতি হয়েছে বেশি।

নদীর বুকে চাষ
ঈশ্বরদী রেল স্টেশনের সাথে হার্ডিঞ্জ ব্রীজের নিচে দেখা গেল অনেকটা এলাকাজুড়ে নদীর বুকে আঁখ, গাজর আর ফুলকপির চাষ হচ্ছে।
পাবনার রূপপুর গ্রামের মজিবুর রহমান জানান, "নদীর পানি কমে যাওয়ায় বছরের প্রায় দুই মাস বাদ দিয়ে বাকিটা সময় অনেকেই নানা ধরনের সবজির চাষাবাদ করেন"।
গঙ্গা নদী যেটি বাংলাদেশে পদ্মা নামেই সুপরিচিত, সেই নদীর পানি বাংলাদেশ ও ভারত প্রতিবেশী দু'টো দেশই যেন ভাগ করে নিতে পারে সেজন্যই ঠিক কুড়ি বছর আগে দুই দেশের সরকার পানি ভাগাভাগির চুক্তিটি করেছিল।
কারণ কলকাতা বন্দরের নাব্যতা রক্ষার কথা বলে ভারত পশ্চিমবঙ্গের ফারাক্কায় গঙ্গার ওপর বাঁধ দেয়, যা চালু করা হয় ১৯৭৫ সালে
এর ফলে শুকনো মৌসুমে বাংলাদেশের ভেতরে পদ্মায় পানি কমে আসে আবার বর্ষা মৌসুমে দেখা যায় উল্টো চিত্র ।

রূপপুর গ্রামের মজিবুর রহমানছবির কপিরাইটবিবিসি
Image captionরূপপুর গ্রামের মজিবুর রহমান। একসময় ফেরিঘাটে কাজ করতেন। নদীতে পানি কমে যাওয়ায় তিনি সেখানে চাষাবাদ করছেন এখন।

তখন ভারতের উজান থেকে আসা অতিরিক্ত পানি বাংলাদেশে ঢুকে তৈরি হয় বন্যা।
গঙ্গা চুক্তির উদ্দেশ্য ছিল শুষ্ক মৌসুমে প্রতি বছর ১লা জানুয়ারি থেকে ৩১শে মে পর্যন্ত ১০ দিনের চক্র করে দুই দেশ পানি ন্যায্যভাবে ভাগ করে নেবে।
কিন্তু চুক্তির কুড়ি বছর পরে এসেও পানি নিয়ে কেন এই হাহাকার?
'পার হয়ে যায় গরু পার হয় গাড়ি'
হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পয়েন্টে নিয়মিতভাবে পানির প্রবাহ পরিমাপ করা হয়।
রোববার পর্যন্ত প্রবাহ পরিমাপ করা হয়েছে ১লাখ ২৪ হাজার কিউসেক।
তার আগের দিন অর্থাৎ শনিবার তা ছিল প্রায় ১লাখ২৬ হাজার কিউসেক।
এমনটাই জানিয়েছে পাবনার পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা।

ব্রিজের নিচ দিয়ে চলছে মোটর সাইকলে, সাইকেল।ছবির কপিরাইটবিবিসি
Image captionব্রিজের নিচ দিয়ে চলছে মোটর সাইকলে, সাইকেল। এ যেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতার মতো পার হয়ে যায় গরু পার হয় গাড়ি।

ভারত থেকে বন্যার কারণে পানি ছাড়ায় গতবারের চেয়ে প্রবাহ এবার অনেক বেশি বলে তারা স্বীকার করেন।
এমন প্রেক্ষাপটে পানি ধরে রাখতে গঙ্গা ব্যারেজ নির্মাণের প্রয়োজনীয়তার কথাবার্তা বিভিন্ন মহলে বলা হলেও, পানি উন্নয়ন বোর্ডের সাবেক কর্মকর্তা মি. সিদ্দিকী বলছেন, এই অঞ্চলের জন্য সেটি হবে উচ্চাভিলাষী প্রকল্প।
কিন্তু পানির অভাবে সেচ কাজ চালাতে না পেরে বিপন্ন হয়ে পড়েছেন পদ্মা তীরের বহু এলাকার মানুষ।
তাদের সহায়তা দেয়ার জন্য একসময় চালু করো হয় গঙ্গা-কপোতাক্ষ প্রকল্প।
সেই প্রকল্পের একজন কর্মকর্তা ওবায়দুল্লাহ সিদ্দিকী বলেন, প্রকল্পটি বেশ গতি নিয়ে শুরু হলেও পানির অভাবে তাও মুখ থুবড়ে পড়ে।
তিনি বলেন, "চুক্তি অনুযায়ী পানি পায়নি বাংলাদেশ।
চুক্তি করার কারণে আন্তর্জাতিক পর্যায়েও বিষয়টি তুলে ধরতে পারছে না বাংলাদেশ, বলেন তিনি।
এক সময় পদ্মার নদীপথে অসংখ্য ছোটবড় জাহাজ এবং মাছধরার নৌকা দিনরাত চলতো ।
কিন্তু এখন শুষ্ক মৌসুমে প্রায় সাড়ে তিনশো' কিলোমিটারের বেশি নৌপথ বন্ধ রাখতে হয়।

চর পড়ছে পদ্মায়ছবির কপিরাইটবিবিসি
Image captionএক সময় নাম পেয়েছিল কীর্তিনাশা পদ্মা। সাহিত্যে বহুলভাবে উঠে এসেছে এই নদীটির নাম। নদীর ঠিক মাঝখানে চর জেগে ওঠায় এখন কোথাও কোথাও তার এমনই চেহারা।

রাজশাহী ছাড়াও কুষ্টিয়া, পাবনা, ঈশ্বরদী, রাজবাড়ী, ফরিদপুরসহ বিভিন্ন দিকে বিভিন্ন নামে প্রবাহিত হয়েছে পদ্মা নদীর শাখা-প্রশাখা ও উপনদী।
কিন্তু বিভিন্ন শাখানদী এরই মধ্যে রয়েছে হুমকিতে। কুষ্টিয়ায় গড়াই নদী তেমনই একটি নদী।
মিস্টার সিদ্দিকী বলেন, পদ্মায় প্রয়োজনীয় প্রবাহ না থাকার কারণে তার প্রভাবে ছড়িয়ে পড়ছে লবণাক্ততাও।
এলাকাটিতে সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেল, এখানকার লোকজনের মধ্যে যারা কিছুটা হলেও খোঁজখবর রাখেন তারা মনে করেন, পানির দাবি আদায় করতে রাজনৈতিক ভাবে ব্যর্থ হয়েছে বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষ।
গঙ্গা চুক্তির বাদবাকি ১০ বছরে প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী পানি বাংলাদেশের কর্তাব্যক্তিরা বন্ধুপ্রতীম দেশের কাছ থেকে কতটা আদায় করতে পারবেন, সেদিকেই তাকিয়ে আছেন পদ্মা তীরের মানুষেরা।


গঙ্গার পানিবণ্টন

গঙ্গার পানিবণ্টন  বাংলাদেশ পৃথিবীর অন্যতম বৃহত্তম বদ্বীপ অঞ্চল। ৫৮টি আন্তর্জাতিক নদীসহ কমপক্ষে ২৩০টি নদ-নদী বিধৌত বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক নদীগুলির মধ্যে ৫৫টির উৎপত্তি ভারত থেকে এবং তিনটি মায়ানমার থেকে। গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনার উপনদী ও শাখানদী বিধৌত মোট এলাকার পরিমাণ ১৭,২০,০০০ বর্গকিলোমিটার। এ এলাকার শতকরা সাত ভাগ বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্ত।
বর্ষা মৌসুমে পানি বৃদ্ধির ফলে দেশের প্রায় এক-চতুর্থাংশ স্থলভাগ জলমগ্ন হয়, আবার শুষ্ক মৌসুমে অধিকাংশ নদীতে প্রবাহ হ্রাস পাওয়ার ফলে জলাভাব দেখা দেয়। উভয় পরিস্থিতিই জনজীবনকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে। এসব নদীর ভাটি অঞ্চলে বাংলাদেশের অবস্থান হেতু নদীগুলির জলপ্রবাহের ওপর এদেশের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। সাত হাজার মিটার উচ্চতায় হিমালয়ের হিমবাহে উৎপন্ন গঙ্গা নদী ভারতের উত্তর প্রদেশ, বিহার ও পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মধ্য দিয়ে ২,৫৫০ কিলোমিটার পথে প্রবাহিত হয়ে বাংলাদেশের গোয়ালন্দের কাছে ব্রহ্মপুত্র নদীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে। বাংলাদেশে গঙ্গার (বাংলাদেশে যা পদ্মা নামে অভিহিত) দৈর্ঘ্য ২৬০ কিলোমিটার। গঙ্গা বিধৌত মোট অঞ্চলের আয়তন ১০,৮৭,০০১ বর্গকিলোমিটার। এর মধ্যে ৮,৬০,০০০ বর্গকিলোমিটার ভারতে, ১,৪৭,১৮১ বর্গকিলোমিটার নেপালে, ৩৩,৫২০ বর্গকিলোমিটার চীনে এবং ৪৬,৩০০ বর্গকিলোমিটার বাংলাদেশে। ভারত ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের প্রথম পরিকল্পনা করে ১৯৫১ সালে। এর ফলে পূর্ব পাকিস্তানে এর সম্ভাব্য বিরূপ প্রতিক্রিয়ার বিষয়ে তখন থেকেই পাকিস্তান সরকার প্রতিবাদ জানাতে থাকে।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্ব ও সহযোগিতার নতুন পথ উন্মুক্ত হয় এবং বাংলাদেশ সরকার গঙ্গার পানি বণ্টনের সমস্যা সমাধানে মোটেও বিলম্ব করে নি। এ অঞ্চলের পানিসম্পদের সুষম বন্টন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ১৯৭২ সালের ১৯ মার্চ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু  শেখ মুজিবুর রহমান ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী একটি স্থায়ী  যৌথ নদী কমিশন গঠনের উদ্দেশ্যে এক যৌথ ঘোষণায় স্বাক্ষর করেন। এ ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৭২ সালের নভেম্বরে একটি যৌথ নদী কমিশন গঠিত হয়। নদী কমিশনের লক্ষ্য ছিল উভয় দেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত নদীগুলি থেকে সর্বাধিক সুবিধা লাভের লক্ষ্যে যৌথ প্রয়াস চালানো, বন্যা নিয়ন্ত্রণের পরিকল্পনা প্রণয়ন ও যৌথভাবে তা বাস্তবায়ন করা, বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বাভাস নির্ণয়ের বিশদ পদক্ষেপ সুপারিশ করা এবং পানিসম্পদের সুষম বণ্টনের ভিত্তিতে বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও সেচ প্রকল্পগুলোর জন্য সমীক্ষা ও জরিপ চালানো। ১৯৭৪ সালের মে মাসে উভয় দেশের প্রধানমন্ত্রী একটি যৌথ ঘোষণাপত্রে একমত প্রকাশ করেন যে, বাংলাদেশ ও কলকাতা বন্দরের পূর্ণ চাহিদা মেটানোর জন্য শুষ্ক মৌসুমে ফারাক্কার কাছে গঙ্গা নদীতে পানির প্রবাহ বৃদ্ধি করা প্রয়োজন এবং এ লক্ষ্যে ফারাক্কা বাঁধ চালু করার আগেই উভয় দেশের মধ্যে একটি গ্রহণযোগ্য চুক্তি সম্পাদন সম্ভব। ১৯৭৫ সালের গোড়ার দিকে একটি অন্তর্বর্তীকালীন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় যাতে ভারতকে ২১ এপ্রিল থেকে ৩১ মে পর্যন্ত ৪১ দিনের জন্য বাঁধের সংযোগ খালগুলো পরীক্ষামূলকভাবে চালু করার অনুমতি দেয়া হয়।
১৯৭৬ ও ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশের তীব্র প্রতিবাদ সত্ত্বেও ভারত একতরফা গঙ্গার পানি প্রত্যাহার করে নেয়। ১৯৭৬ সালের সেপ্টেম্বরে আলোচনার উদ্যোগ ভেঙে যায় এবং বাংলাদেশ বিষয়টিকে আন্তর্জাতিক ফোরামে উত্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়। সমস্যাটি প্রথম উত্থাপিত হয় ১৯৭৬ সালের মে মাসে ইস্তাম্বুলে অনুষ্ঠিত ইসলামি দেশসমূহের পররাষ্ট্র মন্ত্রী সম্মেলনে এবং এরপর ওই বছর আগস্টে কলম্বোতে অনুষ্ঠিত জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের শীর্ষ সম্মেলনে।
১৯৭৬ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৩১তম অধিবেশনে বিষয়টি উত্থাপনের সিদ্ধান্তের ফলে দু’দেশের কূটনৈতিক কর্মকান্ড জোরদার হয়ে ওঠে। সেনেগাল, অস্ট্রেলিয়া ও শ্রীলঙ্কার অনুরোধে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের রাজনৈতিক কমিটি ভারত ও বাংলাদেশকে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে বিষয়টি নিষ্পত্তি করার আহবান জানায়। সিরিয়া, মিশর, শ্রীলঙ্কা, আলজেরিয়া ও গায়ানার মধ্যস্থতায় সাড়া দিয়ে ভারত ও বাংলাদেশ ঢাকায় আলোচনায় বসতে সম্মত হয়। কিন্তু আলোচনা ফলপ্রসূ হয় নি।
ভারতে জনতা দল সরকার গঠনের পর আলোচনার জন্য একটি অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হয় এবং ১৯৭৭ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশের  জিয়াউর রহমান সরকারের সঙ্গে পানি বণ্টন বিষয়ে পাঁচ বছর মেয়াদী একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ১৯৮২ সালে সে চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়। ১৯৮২ সালের ৪ অক্টোবর জেনারেল এরশাদ সরকার ভারতের সঙ্গে পানি বণ্টন বিষয়ে দু বছর মেয়াদী একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করে। ১৯৮৫ সালের ২২ নভেম্বর তিন বছরের জন্য আরেকটি সমঝোতা স্বাক্ষরিত হয়। কিন্তু যেহেতু তখনও পানিপ্রবাহ বৃদ্ধির ব্যাপারে কোনো চুক্তি ছিল না, তাই ভারত পানি বণ্টন বিষয়ক সমঝোতা চুক্তির মেয়াদ আর বৃদ্ধি করতে সম্মত হয় নি। সর্বশেষ চুক্তিতে বাংলাদেশের ৩৪,৫০০ কিউসেক পানি পাওয়ার কথা থাকলেও ভারত ১৯৯৩ সালের শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশে ১০ হাজার কিউসেকেরও কম পানির প্রবাহ রাখে। কোনো চুক্তি কার্যকর না থাকায় ভারত বাংলাদেশকে গঙ্গার পানির ন্যায্য হিস্যা থেকে অব্যাহতভাবে বঞ্চিত করে চলে। ভারতের সঙ্গে আলোচনার অগ্রগতি না হওয়ায় বিএনপি সরকার বিষয়টি আবার জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে উত্থাপন করে। ১৯৯৩ সালের অক্টোবরে সাইপ্রাসে অনুষ্ঠিত কমনওয়েল্থ শীর্ষ সম্মেলনেও তা উত্থাপিত হয়।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর গঙ্গার পানি বন্টন সম্পর্কে নতুন করে আলোচনা শুরু হয় এবং ১৯৯৬ সালের ১২ ডিসেম্বর নয়াদিল্লিতে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ৩০ বছর মেয়াদি গঙ্গার পানি বন্টন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তিতে নির্ধারিত হয় যে, উভয় পক্ষের সম্মতিক্রমে গৃহীত ফর্মুলা মোতাবেক ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ মে পর্যন্ত সময়ে দু’দেশের মধ্যে গঙ্গার পানি ভাগাভাগি হবে, এবং ভারত নদীটির জলপ্রবাহের মাত্রা গত ৪০ বছরের গড় মাত্রায় বজায় রাখার সর্বাত্মক চেষ্টা করবে। যেকোন সঙ্কটময় পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ ৩৫ হাজার কিউসেক পানির নিশ্চয়তা পাবে। দীর্ঘ মেয়াদে গঙ্গার পানি প্রবাহ বৃদ্ধির লক্ষ্যে উভয় দেশ পারস্পরিক সহযোগিতার প্রয়োজনে এবং দুদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত অন্যান্য নদীর পানি বণ্টনের ক্ষেত্রেও অনুরূপ চুক্তিতে পৌঁছানোর ব্যাপারে একমত হয়।
এ দীর্ঘমেয়াদী চুক্তির ফলে বাংলাদেশে গঙ্গার পানিপ্রবাহ বাড়ানোর ক্ষেত্রে ভারতের পূর্বশর্ত প্রথমবারের মতো তুলে নেওয়া হয়, এবং ভাটি অঞ্চলের অংশীদার হিসাবে গঙ্গার বিদ্যমান পানিপ্রবাহে বাংলাদেশের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। এ চুক্তির ফলে দু’দেশের মধ্যকার সম্পর্কের তিক্ত একটি ইস্যুর অবসান ঘটে এবং সমগ্র অঞ্চলের পানিসম্পদ বণ্টনের ক্ষেত্রে বৃহত্তর সহযোগিতার পথ উন্মুক্ত হয়। [এনামুল হক]
আরও দেখুন ফারাক্কা বাঁধ



Comments